আজ- শনিবার, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

অর্থ লোপাটকারী পি কে হালদার ও দুদকের হাতে আটক তার তিন সহযোগীর বাড়ি নাজিরপুরে

তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাঁচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অংকের অর্থ লোপাটকারী পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারসহ দুদকের হাতে গ্রেফতারকৃত তার আরও তিন সহযোগী অবন্তিকা বড়াল, সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধার বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায়। সেই সাথে গ্রেফতারকৃত পি কে হালদারসহ তারা সকলেই সাধারণ পরিবারের সন্তান। তবে বর্তমানে তারা সকলেই বিপুল পরিমান অর্থ ও বিত্ত সম্পদের মালিক। ঢাকায় দামী ফ্লাটবাড়িসহ দেশে বিদেশে রয়েছে অর্থ ও সম্পত্তি।

নিজের নামে মিল রেখে এবং আত্মীয় স্বজনের নামে গড়ে তোলা পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানী (বিআইএফসি)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা পাচারে নায়ক পি কে হালদারের বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজার গ্রামে। পি কে হালদারের বাবা মৃত প্রাণবেন্দু হালদার পেশায় ছিলেন গ্রাম্য বাজারের দর্জি। ১৫/১৬ বছর আগে ভিন্ন ধর্মের এক মহিলাকে বিয়ে করার পর থেকে পি কে হালদার গ্রাম ছাড়া। এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, পি কে হালদার নাজিরপুর উপজেলার দিঘীরজান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেনী, দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও বাগেরহাটের সরকারি পিসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপে জুট ফ্যাক্টরীতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেছেন।

স্থানীয় কলেজ শিক্ষক অধ্যক্ষ দীপ্তেন মজুমদার জানান, পি কে হালদারকে একজন মেধাবী ছাত্র বলে এলাকাবাসী চিনতেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে এলাকার সাথে তার তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। এলাকার লোকজন জানতো প্রকৌশলী পেশায় তিনি বড় চাকরী করেন। ১৫/১৬ বছর আগে এক মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করেছেন বলে গ্রামে প্রচার রয়েছে। তার জীবনযাপন ছিল রহস্যজনক। কুষ্টিয়ায় একটি জুটমিলের মালিকসহ তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ছিল বলে এলাকাবাসী জানে। অঙ্গণ হালদার নামে দীঘিরজান এলাকার জনৈক ব্যক্তি ম্যানেজার হিসেবে পি কে হালদারের ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করেন। দীঘিরজানের গ্রামে বাড়ীতে মা লীলাবতী একটি কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তারও তত্ত্বাবধায়ক অঙ্গণ হালদার। পি কে হালদারের গ্রামে বাড়ীতে পুরানো একটি কাঠের টিনসেড ঘর আছে, যেখানে বাড়ীতে থাকা অন্য লোকজন বসবাস করেন।

দুদকের হাতে আটক পি কে হালদারের সহযোগী কাম বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল ওরফে কেয়া এর গ্রামের বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে। তবে পিরোজপুর শহরের খুমুরিয়া এলাকায়ও তাদের একটি বাড়ি রয়েছে। অবন্তিকার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অরুণ কুমার বড়াল ছিলেন সরকারী কলেজের প্রভাষক। তিনি পিরোজপুর সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজেও শিক্ষকতা করেছেন। অবন্তিকা বড়াল ও তার অপর দুই ছোট বোন পিরোজপুরের খুমুরিয়া এলাকার বাসায় থেকে লেখাপড়া করেছে। পরে বাবা মারা যাওয়ার পরে এবং এখানকার লেখাপড়ার পাঠ শেষ করে অবন্তিকা ঢাকায় গিয়ে লেখাপড়া শুরু করে। তবে শোনা গেছে, পিরোজপুরে লেখাপড়া করাকালীন সময়ে অবন্তিকা মুসলিম এক ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এ কারণেই পরিবার থেকে তড়িঘড়ি করে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডির ১০/এ সাত মসজিদ রোডে দামী ফ্ল্যাট রয়েছে অবন্তিকার। কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ওই ফ্ল্যাটে তার বিধবা মা অর্পনা বড়াল ও অন্য দুই বোন বসবাস করছে। দুদকের হাতে অবন্তিকা গ্রেফতার হওয়ার কয়েক দিন আগে তার মা অপর্না বড়াল পিরোজপুরের বাড়িতে এসেছিল। তবে দুই তিন দিন থাকার পরেই হঠাৎ করে আবার ঢাকায় চলে যা তিনি। জানা গেছে, অপর্না বড়াল পিরোজপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় সরকারী ঘর বরাদ্ধ পাওয়ার জন্য দৌঁড়ঝাপ করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুমুরিয়া এলাকার তাদের এক প্রতিবেশী জানান, অবন্তিকা বড়াল গ্রেফতার হওয়ার কয়েক দিন আগে তার মা খুমুরিয়ার বাসায় এসেছিল। প্রতিবেশী হওয়ায় তখন আমাদের বাসায়ও এসেছিল। তখন সে তার মেয়ের ফ্ল্যাট বাড়ির গল্পও দিয়েছে যে, মেয়ে তিন কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট কিনেছে। ওই প্রতিবেশী জানান, অবন্তিকার বাবা মারা যাওয়ার পরে যে পরিবারটি ছিল খুবই দুরাবস্থার মধ্যে, অথচ কয়েক বছরের ব্যবধানে তারা কয়েক কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট কিনে কিভাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পিরোজপুরের খুমুরিয়া এলাকায় অবস্থিত বাড়িটি তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।

এদিকে, পিকে হালদারের সহযোগী দুদকের হাতে আটক সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অবন্তিকা মৃধার বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়েনের বাকসি গ্রামে। সুকুমার মৃধার বাবার নাম রাজেন্দ্রনাথ মৃধা। তিনি ছিলেন গ্রাম্য চৌকিদার। সুকুমার মৃধা একজন আয়কর আইনজীবী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে সুকুমার মৃধা নিজ গ্রাম নাজিরপুর, পিরোজপুর ও খুলনায় হঠাৎ করে দানশীল, শিক্ষানুরাগী, সংবাদপত্র সেবী ও সমাজসেবক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি হয়ে উঠেন। নিজ এলাকা বাকসী গ্রামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মানসহ শেখমাটিয়া ইউনিয়ন ও নাজিরপুর উপজেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মানে বিপুল পরিমান অর্থ অনুদান দেন।

পেশাগত জীবনে সুকুমার মৃধা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, খুলনা রূপসা কলেজের অধ্যক্ষসহ একাধিক চাকুরী করেছেন। তবে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারান বলে জানা গেছে।

তিনি নিজ গ্রাম বাকসিতে রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে সরকারি খাস জমিতে মহাবিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মন্দির, দুঃস্থ ছাত্রী নিবাস, বৃদ্ধাশ্রমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এছাড়া এলাকায় বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির ও মাদ্রাসায়ও দিয়েছেন অনুদান। খুলনায় আলোকিত বাংলাদেশ নামে অধুনালুপ্ত একটি  সংবাদপত্রও ছিলো সুকুমার মৃধার। বৃদ্ধাশ্রম ও দুঃস্থ ছাত্রী নিবাস সমাজসেবা অধিদপ্তরের অর্থায়নে পরিচালিত হলেও স্থানীয়দের অভিযোগ এটা নিজস্ব অর্থায়নে চলে বলে দাব করতেন সুকুমার মৃধা। তিনি পার্শ্ববর্তী বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার আন্ধামানিক গ্রামে ৫০ বিঘা জমিতে একটি হরিণের খামার গড়ে তুলেছেন। সেখানে বন আইন লংঘন করে হরিণ বিক্রি ও মহল বিশেষকে ম্যানেজ করতে হরিণের মাংস উপহার দেয়ার অভিযোগও রয়েছে সুকুমার মৃধার বিরুদ্ধে। তিনি পি কে হালদারের দেহরক্ষীর সাথে মেয়ে অনিন্দিতাকে বিয়ে দিয়েছেন। তার বোন মঞ্জু রানীর দুই ছেলে স্বপন মিস্ত্রি ও উত্তম মিস্ত্রি পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী। এ দু’জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে দুদক তাদের দেশের বাইরে যেতে নিষেধাজ্ঞারোপ করছে। তবে স্বপন বর্তমানে ভারতে ও উত্তম দেশে আত্মগোপন করে আছে।

স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, পি কে হালদার মাঝে মাঝে সুকুমার মৃধার বাকসি গ্রামের রাজলক্ষ্মী ফাউন্ডেশনের গেস্টহাউজে আসতেন। তার সাথে তখন মেয়ে বান্ধবীও থাকতো।

বিভাগ: অন্যান্য,জাতীয়,টপ নিউজ,ফিচার,বরিশাল বিভাগ,ব্রেকিং নিউজ,মিডিয়া,সারাদেশ