আজ- শুক্রবার, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চাপে ফেলবে মধ্যবিত্তকে

নতুন বাজেট মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষকে আরও চাপে ফেলে দেবে। নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ফলে কিছু নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে। দিতে হবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। এতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

এক বছর ধরেই জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ করতে হয়েছে এই সীমিত আয়ের ছোট করদাতাদের। করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি না করায় তাঁদের এখন আগের মতোই কর দিতে হবে। এতে করসহ অন্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের সঞ্চয় কমবে। নতুন বছর থেকে মধ্যবিত্তকে ব্যাংকে টাকা রাখতে খরচ আরও বেড়ে যাবে। ব্যাংক হিসাবে আগের চেয়ে আবগারি শুল্ক বেশি দিতে হবে। সব মিলিয়ে নতুন এই বাজেট থেকে মধ্যবিত্তের খরচই বাড়ল।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের ১৫ শতাংশ ভ্যাট জীবনযাত্রার খরচ বাড়াবে। এই আইনটি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত সময় নির্ধারণ সঠিক হয়নি। এমনিতেই এখন ধান-চালের দাম বাড়ছে। নতুন আইনের কারণে অন্য পণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা আছে। এতে সার্বিক জীবনযাত্রা আরও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে।

ঘরে-বাইরে ভ্যাটের চাপ

নতুন ভ্যাট আইনে নিত্য ভোগ্যপণ্যে যে অব্যাহতি আছে, তা আগেও ছিল। এতে নতুন আইনটি মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বাড়তি কোনো সুবিধা আনতে পারেনি। কাপড়চোপড়, চা, বোতলজাত পানি, টুথপেস্ট, ব্রাশ, আসবাবের অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট বসবে। বিদ্যুৎ বিলেও আগের চেয়ে বেশি ভ্যাট দিতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ যদি দাম না কমায়, তবে বাড়তি খরচ করতে হবে গ্রাহককে। এবার আসি ঘরের বাইরের কথায়, রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এসি বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে যাতায়াত করলেও খরচ বাড়বে।

এই বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারলে পণ্য বা সেবার দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইনের অজুহাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিতে পারেন। ক্রেতাদের এ বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। তাঁদের জানতে হবে, কোন কোন পণ্যে ভ্যাট আছে, কোনটিতে নেই। সরকারের এই বিষয়ে প্রচারণা চালানো উচিত।

নতুন ভ্যাট আইনটির সাফল্য নির্ভর করছে আমদানি বা উৎপাদন পর্যায় থেকে সরবরাহ পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীদের সঠিক হিসাব রাখার ওপর। ব্যবসায়ীরা যদি সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারেন, তবে নিজের দেওয়া ভ্যাটের টাকা রেয়াত নিতে পারবেন। সঠিক হিসাব না রাখলে শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের টাকা ভোক্তার পকেট থেকেই যাবে।

ব্যাংকে টাকা রাখলে বেশি খরচ

ব্যাংকের গচ্ছিত টাকার ওপরে এমনিতেই সুদের হার কম। চলতি হিসাবে তো সুদের হার ৩-৪ শতাংশের মতো, যা গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের মতো। এ অবস্থায় ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে এনবিআর। বছরে একবার এই শুল্ক দিতে হয়। এর ফলে ১ লাখ টাকার বেশি থাকলেই আগের চেয়ে বেশি শুল্ক দিতে হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুসারে, ছোট সঞ্চয়কারীর জন্য কিছুটা ছাড় দিয়ে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো আবগারি শুল্ক বসবে না। ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হতো; এখন আর দিতে হবে না। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে। ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত দেড় হাজারের পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা দিতে হবে। ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক সাড়ে ৭ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর ৫ কোটি টাকার বেশি থাকলেই ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে।

আবগারি শুল্ক হিসাব করা হয়, সারা বছরে কোনো গ্রাহকের হিসাবে কোনো এক দিন সর্বোচ্চ কত টাকা ছিল। এর মানে হলো, কারও হিসাবে টাকার পরিমাণ বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। কিন্তু সর্বোচ্চ বেড়েছিল যেদিন, সেদিনের পরিমাণটির ওপর আবগারি শুল্ক বসে। বছরে একবারই দিতে হবে হিসাব গ্রাহককে।

 এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির সময়টি সঠিক হয়নি। কেননা ব্যাংকে সুদের হার মূল্যস্ফীতির চেয়েও কম। এতে ব্যাংকে টাকা রাখলে এক বছর পর সুদের টাকা যোগ করলেও এর মূল্যমান আগের চেয়ে কমে যায়। এখন আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করায় তা আরও কমে যাবে। তবু কিছু মানুষ হয়তো দায়ে পড়ে ব্যাংকে টাকা রাখবে।

করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত

করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই আড়াই লাখ টাকা রাখা হয়েছে। এতে সীমিত আয়ের মানুষ চাপে থাকবেন। কেননা, চলতি অর্থবছরে গড়ে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের মতো ছিল। এর মানে, করমুক্ত আয়সীমার কিছু ওপরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের জীবনযাত্রায় খরচ সাড়ে ৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির জন্য বাড়তি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সামনে একই হারে কর দিতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে ছোট করদাতার খরচ বাড়বে, সঞ্চয় কমবে।

করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি না করার ফল অনেকের জন্য সুখকর না-ও হতে পারে। যাঁরা গতবার আড়াই লাখ টাকার কাছাকাছি গিয়ে করজালের বাইরে ছিলেন, কিন্তু এবার বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই সীমা পেরিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের ভুগতে হবে। তাঁরা করজালে আটকে যাবেন। করমুক্ত আয়সীমা না বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী একটি ফাঁদ পেতেছেন। বেশি লোক করজালে আটকে যাবেন। এর ফলে যেসব সরকারি কর্মকর্তা নতুন স্কেলে বেতন-ভাতা পুরোটা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই করজালে আটকাবেন।

তবে প্রতিবন্ধী করদাতারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। তাঁদের ন্যূনতম করমুক্ত সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। সোয়া ২ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক বড়লোকদের আয়করের ওপর সারচার্জ হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল ব্যবসায়ীদের আয়ের ওপরে আড়াই শতাংশ সারচার্জ বসানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, আয়ের ওপর কর বসে, সারচার্জ বসানো কতটা যৌক্তিক।

বেসরকারি চাকরিজীবীরা বিপাকে

গত বাজেটে বেসরকারি খাতের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে ব্যবসা বা পেশার নির্বাহীদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলো। গতবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী টিআইএন বাধ্যতামূলক করায় টিআইএনধারীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছিল। এই পেশাজীবীরা যেন এনবিআরের জন্য ‘সোনার খনি’র মতো। তাই এই সুযোগটি হাতছাড়া করেনি এনবিআর। এখন ওই সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের রিটার্ন দিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতেই হবে।

ছাড়ও আছে

করমুক্ত আয়সীমা কিংবা কর হারে ছাড় না দিলেও রিটার্ন জমার পদ্ধতিতে কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার কম হলে তা আয়কর বিবরণী জমার সময় সম্পদ বিবরণী ঐচ্ছিক করা হয়েছে। বর্তমানে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্পদ থাকলে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া ঐচ্ছিক ছিল। এর ফলে মধ্যবিত্তরা কিছুটা ছাড় পাবেন। যাঁদের বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিজমা নেই, বেতন-ভাতা কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা থেকে আয় করেন, তাঁরাই এ ছাড় পাচ্ছেন। প্রান্তিক করদাতারা এ সুবিধা পাবেন।

আয়কর অধ্যাদেশের ৮২ বিবি ধারা সংশোধন করে করদাতাদের স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। বার্ষিক রিটার্নে কোনো করদাতা ১৫ শতাংশ বেশি আয় দেখালে নিরীক্ষায় ফেলবে না এনবিআর। রিটার্নে ভুল ধরা পড়লে কর কর্মকর্তা অবশ্যই ওই করদাতাকে জানাতে হবে। ওই করদাতা ভুল সংশোধন করে পুনরায় রিটার্ন জমার সুযোগ পাবেন। কর কর্মকর্তা রিটার্ন বিবরণী নিরীক্ষা করে কিছু না পেলে কর নিয়ে পরিমাণ পুনর্মূল্যায়ন করতে পারবেন না। ওই করদাতা পুনরায় সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করে কর দিতে পারবেন।

কমবে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্র নিয়ে তেমন কোনো কিছু বলেননি। বাজেট ঘোষণার পরদিনই সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী শিগগিরই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন বাজেটে ব্যাংকে টাকা রাখার খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষকে চাপের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমালে তাদের আরও কোণঠাসা করে ফেলবে। ব্যাংকে টাকা রাখলে খরচ বাড়বে; আবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমবে। নিরাপদে টাকা রাখা মধ্যবিত্তের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

পোশাকশিল্পে উৎসে কর

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের করপোরেট কর হার ২০ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ কমিয়ে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে উৎসে কর দশমিক ৭ শতাংশের মেয়াদ জুন মাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরপর ১ শতাংশ হারে উৎসে কর বসবে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের করপোরেট কমানো হলেও উৎসে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। বছরজুড়ে রপ্তানিকালে যে উৎসে কর দেওয়া হয়, সেই পরিমাণটি করপোরেট কর হিসেবে দেখান রপ্তানিকারকেরা। অভিযোগ আছে, তৈরি পোশাক খাতে করপোরেট কম হলে অনেক রপ্তানিকারক করদাতা নিজের অন্য প্রতিষ্ঠানের আয় এখানে দেখান। এতে অন্য প্রতিষ্ঠানটি লোকসানি দেখাতে সুবিধা হয়।

অন্যান্য খাতে এবারও করপোরেট কর হারে কোনো পরিবর্তন করেননি অর্থমন্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা এই দাবি করে আসছেন। করপোরেট কর না কমানোর ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যবসায় খরচ কমানোর একটি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন।

বাড়বে ভ্রমণ খরচ

আকাশপথে বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে খরচ বাড়বে। ভ্রমণ কর দ্বিগুণ করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশে ১ হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা এবং ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশে দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ টাকা বিমান টিকিটের সঙ্গে কেটে রাখা হবে। উচ্চ মধ্যবিত্ত বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ভালো বেতনের কর্মকর্তাদের অনেকে একা কিংবা সপরিবারে অন্তত বছরে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরতে যান। এখন তাঁদের খরচ বাড়বে।

 

প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টি অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে

আয়করে নজর দেওয়া উচিত ছিল, ভ্যাটে নয়

বাজেটে নেই চট্টগ্রামের সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর

মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বাজেট

বিভাগ: অন্যান্য